স্বাস্থ্য পরামর্শ

করোনা পরবর্তী শারীরিক ও মানসিক জটিলতা

করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পরও শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা থেকে যায়। বিশেষত চরম শারীরিক দুর্বলতা। দু’-এক সপ্তাহ পর্যন্ত এ রকম দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। যেকোন অসুস্থতায়, বিশেষ করে ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর এটা হয়ে থাকে। কিন্তু করোনা থেকে সেরে ওঠার পর অনেকেই মাস, এমনকি বছরব্যাপী ক্লান্তি আর দুর্বলতায় ভোগেন।

কারণ : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা এক পর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সক্রিয় হয়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রদাহের সৃষ্টি করে। যার ফলে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।

সাধারণত শারীরিক দুর্বলতা ও অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠার মতো সমস্যাগুলো থেকে যায়। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ব্যথা, অবসাদ এবং ক্লান্তি ভাব হয়। কারও গা, হাত-পা জ্বালাপোড়া ও ঝিনঝিন করে। বিষণ্ণতা আর অবসাদগ্রস্ততা চেপে বসে। কারও পেটে অস্বস্তির অনুভব হয়। সামান্য শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমেই বেড়ে যায় নানা উপসর্গ। কেন এমনটা ঘটে, তার সুনির্দিষ্ট উত্তর এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের জানা নেই। এছাড়া রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, লিঙ্গ ও বয়স ভেদে একেকজনের লক্ষণ একেক মাত্রার হ’তে পারে।

ফুসফুস : করোনাভাইরাস সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ফুসফুসে। অনেকে করোনাভাইরাস নেগেটিভ হওয়ার পরও তার কাশি, শ্বাসকষ্ট দীর্ঘদিন ধরে থেকে যেতে পারে। ফুসফুসের এই দুর্বলতার কারণে দেখা যায় রোগীরা অল্পতেই খুব হাঁপিয়ে ওঠেন। ভীষণ দুর্বলতা ও ক্লান্তিবোধ কাজ করে।

আবার যেসব রোগীদের আইসিইউ বা যরূরী অক্সিজেন নিতে হয়েছে তাদের অনেকের ফুসফুসে পালমোনারি ফাইব্রোসিস সমস্যা দেখা দিতে পারে। যার ফলে রোগীর স্বাভাবিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়। বুকে চাপ দিয়ে ব্যথা করে। ভারী ভারী লাগে।

হৃদপিন্ড : কোভিড-১৯ ফুসফুসের রোগ বলা হ’লেও এটি হৃদপিন্ডের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণার অংশ নেয়া কোভিড রোগীদের ৭৮% পরবর্তীতে হৃদপিন্ডের নানা জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছেন।

লিভার : ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হ’লে লিভার স্বাভাবিক সময়ের চাইতে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর পরিস্থিতি যদি জটিল পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাহ’লে পরবর্তীতে তাদের জন্ডিস, লিভার ফেইলিওর হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে।

মানসিক সমস্যা : করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পরও অনেক রোগী দেখা গেছে দীর্ঘদিন ধরে মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্ণতায় ভুগেন। অনেকেই কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। ছোটখাটো বিষয় ভুলে যাচ্ছেন, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন। এদিকে অনেকের কোভিডের পর অস্বাভাবিক হারে চুল পড়তে থাকে। এছাড়া চোখের প্রেশার বা চোখের নানা প্রদাহজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগও এসেছে।

কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার পরেও অনেকের ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, ওজন খুব দ্রুত কমে যায়। ফলে প্রেশার লো হয়ে আসে। আবার যারা হাইপার টেনশনে ভোগেন তাদেরও প্রেশার হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের রক্তে চিনির পরিমাণ খুব দ্রুত ওঠা নামা করে।

যেসব রোগীদের অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ এর নীচে নেমে যায় তাদেরকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে অক্সিজেন দিতে হয়। পরিস্থিতি জটিল হলে চিকিৎসকরা রোগীকে স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন। স্টেরয়েড তাৎক্ষণিক জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখলেও এর ফলে ডায়াবেটিস ও প্রেশার অনিয়ন্ত্রিত হ’তে পারে।

করণীয় :

পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম : করোনা থেকে সেরে ওঠার সময় শারীরিক-মানসিক বিশ্রাম খুবই যরূরী। নেগেটিভ হওয়ামাত্র কাজে যোগ দেওয়া যাবে না। টিভি, ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন। দেহ-মনকে শান্ত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন, বেশি বেশি ছালাত আদায় করুন, কুরআন তেলাওয়াত করুন বা শুনুন, বই পড়ুন।

পর্যাপ্ত ঘুম : পর্যাপ্ত ঘুম খুব যরূরী। শোয়ার ঘর অন্ধকার ও আরামদায়ক হ’তে হবে। রুটিন করে সঠিক সময়ে ঘুমাতে হবে।

পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার ও পানীয় : পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। খাদ্যতালিকায় আমিষ, শর্করার পাশাপাশি টাটকা ফলমূল ও শাকসবজি রাখুন। প্রতিদিন ২-৩ লিটার পানি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলের রস পান করুন।

নিজেকে সচল রাখা : নিজেকে আস্তে আস্তে সচল রাখতে সচেষ্ট হোন। বিছানা থেকে উঠে নড়াচড়ার চেষ্টা করুন। শুয়ে শুয়ে পায়ের ব্যায়াম করুন। দুর্বল বোধ করলে ১০ মিনিট দিয়েই শুরু করেন, হালকা শরীর চর্চা করুন, হাঁটুন। এরপর ১৫ মিনিট তারপর আধা ঘণ্টা সময় বাড়িয়ে দিন।

শ্বাসতন্ত্রের ব্যায়াম : নিয়ম করে রেসপিরেটরি এক্সারসাইজ করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফুসফুসের ব্যায়ামগুলো শিখে নিন।

মনকে উদ্দীপ্ত রাখা : মনকে সতেজ ও উদ্দীপ্ত রাখার চেষ্টা করুন। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান। সরাসরি সম্ভব না হ’লে অনলাইনে যোগাযোগ করুন।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি : এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে ভিটামিন ডি। যার উৎস হল সূর্য। বিশেষত সকাল ৯টা থেকে ১১টা এই সময়ে শরীরের চামড়ায় সরাসরি রোদ লাগানোর চেষ্টা করুন!

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Back to top button