ছাদ কৃষি

ছাদে আনার বা বেদানার চাষ পদ্ধতি

ডালিমের উন্নত জাতই হ’ল আনার বা বেদানা। আনার বা বেদানা খুবই মিষ্টি, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি ফল। বাংলাদেশের মাটি বেদানা চাষের উপযোগী। এটি দেশের বসতবাটির আঙ্গিনায় চাষ করা যায়। নিয়মিত যত্ন নিলে আনার গাছ থেকে সারা বছর ফল পাওয়া যায়। ছাদে টবে বা ড্রামে খুব সহজেই আনার বা বেদানার চাষ করা যায়।

বেদানার চাষ পদ্ধতি : ছাদে আনার বা বেদানার চারা লাগানোর জন্য ২০ ইঞ্চি কালার ড্রাম বা টব সংগ্রহ করতে হবে। ড্রামের তলায় ৩-৫ টি ছিদ্র করে নিতে হবে। যাতে গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে। টব বা ড্রামের তলার ছিদ্রগুলো ইটের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। টব বা ড্রামের গাছটিকে ছাদের এমন জায়গায় রাখতে হবে যেখানে সবসময় রোদ থাকে। এবার ২ ভাগ বেলে দোআঁশ মাটি, ১ ভাগ গোবর, ৪০-৫০ গ্রাম টি,এস,পি সার, ৪০-৫০ গ্রাম পটাশ সার এবং ২০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া একত্রে মিশিয়ে ড্রাম বা টবে পানি দিয়ে রেখে দিতে হবে ১০-১২ দিন। অতঃপর মাটি কিছুটা খুচিয়ে দিয়ে আবার ৪-৫ দিন একইভাবে রেখে দিতে হবে। মাটি যখন ঝুরঝুরে হবে তখন একটি সবল সুস্থ কলমের চারা উক্ত টবে রোপন করতে হবে। চারা রোপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়া যেন মাটি থেকে আলাদা না হয়ে যায়। চারা গাছটিকে সোজা করে লাগাতে হবে। সেই সাথে গাছের গোড়ায় মাটি কিছুটা উচু করে দিতে হবে এবং মাটি হাত দিয়ে চেপে চেপে দিতে হবে। যাতে গাছের গোড়া দিয়ে বেশী পানি না ঢুকতে পারে। একটি সোজা কাঠি দিয়ে গাছটিকে বেধে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর প্রথমদিকে পানি কম দিতে হবে। আস্তে আস্তে পানি বাড়াতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে, আবার বেশী শুকিয়েও না যায়।

অন্যান্য পরিচর্যা : আনার বা বেদানা গাছের চারা লাগানোর ৪/৫ মাস পর থেকে নিয়মিত ২৫-৩০ দিন অন্তর অন্তর সরিষার খৈল পচা পানি প্রয়োগ করতে হবে। সরিষার খৈল ১০ দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই পচা খৈলের পানি পাতলা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। ১ বছর পর টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করে দিতে হবে। ২ ইঞ্চি প্রস্থে ও ৬ ইঞ্চি গভীরে শিকড়সহ মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে তা ভরে দিতে হবে। মাটি পরিবর্তনের এই কাজটি সাধারণতঃ বর্ষার শেষ এবং শীতের আগে করলেই ভাল হয়। ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর টব বা ড্রামের মাটি কিছুটা খুঁচিয়ে দিতে হবে।

গাছে সার প্রয়োগ : চারা লাগানোর আগে গর্তে সার প্রয়োগ ছাড়াও প্রতি বছর গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। গর্ত করার ৮-১০ দিন পর গর্তের মাটির সাথে নিম্নলিখিত হারে সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরার ২০/২৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে। কমপোস্টের গুঁড়া ৫০০ গ্রাম, ইউরিয়া     ১৫০ গ্রাম, টিএসপি   ১০০ গ্রাম, এমওপি ১০০ গ্রাম, জিপসাম ৭০ গ্রাম।

এক বছর বয়সের প্রতিটি গাছে ১০ কেজি গোবর সার, ১২৫ গ্রাম ইউরিয়া, ১২৫ গ্রাম ট্রিপুল সুপার ফসফেট ও ১২৫ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি বছর সারের মাত্রা কিছু কিছু বাড়াতে হবে। এভাবে একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছের সারের মাত্রা হবে ৬০ কেজি গোবর সার, ১.৫ কেজি ইউরিয়া, ১.৫ কেজি ট্রিপুল সুপার ফসফেট ও ১.৫ কেজি মিউরেট অব পটাশ। উপরোক্ত পরিমাণ সার দু’ভাগে ভাগ করে একভাগ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ও আরেক ভাগ আশ্বিন-কার্তিক মাসে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।

আগাছা দমন : ডালিমের চাষাবাদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া একান্ত প্রয়োজন। ডালিম গাছের গোড়ায় যেন কোন আগাছা লেগে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য নিয়মিতভাবে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।

পানি সেচ ও নিষ্কাশন : ফলন্ত গাছে নিয়মিত হাল্‌কা সেচ দিতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি কখনই বেশী শুকনো বা পানি জমে থাকবে না। ছোট অবস্থায় ও সার প্রয়োগের পর মাটিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে।

ডাল ছাটাই : ছাদের আনার গাছের ডাল নিয়মিত ছাটাই করতে হবে। আনার বা বেদানা গাছের পুরাতন ডালের নতুন শাখায় ফুল আসে। পুরাতন ডালে নতুন শাখা বের করার জন্যই ডাল পালা ছাটাই করা প্রয়োজন। এছাড়াও আনার গাছের শিকড় থেকে বের হওয়া সাকারও ছেঁটে দেয়া দরকার।

শিকড় ছাঁটাই : গাছকে বর্ষায় ফুল আসতে বাধ্য করার জন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে ১৫ সে.মি. গভীর করে মাটি খুঁড়ে শিকড়গুলোকে ১৫ দিন উন্মুক্ত করে রাখতে হবে এবং পরে জৈব সারসহ মাটি চাপা দিয়ে সেচ দিতে হবে।

বিশেষ পরিচর্যা :  ডালিম গাছে সারা বছরই কিছু না কিছু ফুল আসে। তবে সব সময়ের ফুল থেকে ফল উৎপন্ন হয় না। বসন্তকালে যে ফুল হয় সেই ফুল থেকে গ্রীষ্মকালে ফল হয়। যদিও এই ফলের মান খুব একটা ভালো হয় না। বর্ষার শুরুতে যে ফুল আসে এবং সেই ফুল থেকে যে ফল হয় তা কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে সংগ্রহের উপযুক্ত হয় এবং এ ফলের মান বেশ ভালো হয়। তাই বর্ষার শুরুতে ফুল আনার জন্য পৌষ মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত গাছের বিশেষ পরিচর্যা নিতে হয়। এই সময়ে গাছে পানির সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হয়। ফলে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ থাকে। চৈত্র মাসে গাছে সেচ দিতে হয় এবং কোদাল দিয়ে কুপিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আল্‌গা করে দিতে হয়। চৈত্র মাসে গাছের পাতা ঝরে যায় ও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত গাছ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। বর্ষা শুরু হওয়ার আগে দু’একটা সেচ দিলে ভালো হয়। বর্ষা শুরু হওয়ার সাথে সাথে গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফল ধারণ শুরু হয় এবং কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে এই ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। 

ডালিমের রোগবালাই তার প্রতিকার :

ফলছিদ্রকারী পোকা : ডালিম ফলের মারাত্মক শত্রু হচ্ছে ডালিমের প্রজাপতি বা ফল ছিদ্রকারী পোকা। এই প্রজাতির শূঁককীট ফলের ক্ষতি করে থাকে।

প্রতিকার : আক্রান্ত ফল গাছ থেকে পেড়ে বা মাটিতে পড়ে থাকা ফল কুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে। গাছে ফলধারণের পর ফলের বৃদ্ধি শুরু হ’লে কাপড় বা পলিথিন বা বাটার কাগজ দিয়ে বৃদ্ধিমান ফল ব্যাগিং করে দিলে এ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে ম্যালাথিয়ন বা কার্বরিল বা ফস্‌ফামিডন গ্রুপের কীটনাশক দিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর গাছে ও ফলে স্প্রে করতে হবে।

কান্ড ছিদ্রকারী পোকা : কান্ড ছিদ্রকারী পোকা সাধারণত পরিচর্যাবিহীন গাছে আক্রমণ করে থাকে। এই পোকার শূঁককীট রাতের বেলা কান্ড ও শাখার ছাল ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ভেতরের অংশ খেতে থাকে। দিনের বেলা ডালের গর্তের মধ্যে এরা লুকিয়ে থাকে ও বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করে। কান্ড বা শাখায় ছোট ছোট ছিদ্র বা বর্জ্য পদার্থ দেখে এ পোকার আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়।

প্রতিকার : গর্তের মধ্যে সরু তার ঢুকিয়ে পোকার কীড়াকে খুঁচিয়ে মারার ব্যবস্থা করতে হবে। গর্ত থেকে এ পোকার কীড়ার বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করে গর্তে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বা তুলার সাহায্যে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢুকিয়ে কাদা দিয়ে গর্ত বন্ধ করে দিলে পোকা মারা যাবে।

রস শোষণকারী পোকা :   ছাতা পোকা, সাদা মাছি, শুল্ক বা আঁশ পোকা, থ্রিপস, জাব পোকা ও মাকড় ডালিমের রস শোষণকারী পোকা হিসাবে চিহ্নিত। এসব পোকার আক্রমণে পাতা, মুকুল, ফুল ও ছোট ফল খসে পড়ে। সাদা মাছি ও জাব পোকা পাতা ও কচি ডগার রস চুসে খায়। ফলে আক্রান্ত অংশ বিবর্ণ ও বিকৃত হয়ে যায়।

প্রতিকার : ছাতা পোকা ও শুল্ক পোকার কীট দমনের জন্য আক্রমণের প্রথম অবস্থায় আক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এর পর প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে মনোক্রোটোফস বা ডায়াজিনন গ্রুপের কীটনাশক মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। জাব পোকা বা সাদামাছি দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে ডাইমিথয়েট বা আধা মিলিলিটার হারে ফসফামিডন বা ডায়াজিনন গ্রুপের কীটনাশক মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর গাছে দুই বার স্প্রে করতে হবে।

ফলের দাগ রোগ : এটি একটি ছত্রাকঘটিত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত ফলের ওপর ছোট ও অনিয়মিত দাগ পড়ে। দাগগুলোর চারিদিকে সবুজ হলদে দাগ থাকে। পরবর্তীতে দাগগুলো লম্বা দাগে পরিণত হয় এবং ফলের খোসার নিচের বীজগুলো বাদামী বর্ণের হয়ে যায়। আক্রান্ত ফলের গুণাবলী নষ্ট হয়ে যায় এবং ফলের বাজার মূল্য কমে যায়।

প্রতিকার : রোগাক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মেনকোজেব বা ১ গ্রাম হারে কার্বান্ডিজম  ছত্রাকনাশক গুলে ১০ দিন অন্তর অন্তর ৩-৪ বার ফলে ও গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।

ফল পচা রোগ : ছত্রাকঘটিত এ রোগটি সাধারণত বর্ষাকালে দেখা যায়। এ রোগের জীবাণু দ্বারা ফুল আক্রান্ত হ’লে ফলধারণ বিঘ্নিত হয় এবং কচি ফল ঝরে যায়।

প্রতিকার : এ রোগের প্রতিকার ফলের দাগ রোগের প্রতিকারের অনুরূপ।

ফল ফেটে যাওয়া : ডালিমের ফল ফেটে যাওয়া একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি কোন ছত্রাকজনিত রোগ নয়। এটি সাধারণত পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত কারণে বা মাটিতে রসের তারতম্যের কারণে হয়ে থাকে।

প্রতিকার : ফল ধারণের পর থেকে ডালিম গাছে ঘন ঘন পানি সেচ দিতে হবে। মাটিতে বোরনজনিত সার যেমন বোরিক এসিড গাছপ্রতি ৪০ গ্রাম হারে মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া ফলের বৃদ্ধির সময় প্রতি লিটার পানিতে পাঁচ গ্রাম হারে বোরিক এসিড এর মিশ্রণ ১০ দিন অন্তর অন্তর ফলে ও গাছে স্প্রে করতে হবে।

ফল সংগ্রহ : কলমের গাছে ৩-৪ বছর থেকেই ফলন শুরু হয়। ফুল আসার পর থেকে ফল পাকা পর্যন্ত ৬ মাস সময় লাগে। পুষ্ট ফলের খোসার রঙ হলদে-বাদামী হয়ে এলেই ফল পাড়ার উপযুক্ত হয়। গাছে ফল বেশী দিন রেখে দিলে ফল ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফল ফেটে যাওয়া জাতের ওপর নির্ভরশীল। যেসব গাছে ফল ফেটে যাওয়ার প্রবণতা থাকে সেসব গাছের ফল পুষ্ট হওয়ার কিছু আগেই পেড়ে নিতে হয়। তবে অপুষ্ট ফলের স্বাদ ও গুণাগুণ খুব একটা ভালো হয় না। ডালিমের খোসা বেশ শক্ত এজন্য পাকা ফল অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায় এবং পরিবহনেও নষ্ট হয় না।

ফলন : ডালিম গাছ চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে ফল দিতে শুরু করে। তবে শুরুর দিকে ফলন আশানুরূপ হয় না। সাধারণত ৮-১০ বছর বয়স থেকে ডালিম গাছ ভালো ফলন দিয়ে থাকে। প্রথম ফল ধরার সময় গাছপ্রতি ২০-২৫টির বেশী ফল পাওয়া যায় না। দশ বছর বয়সের গাছে গড়ে ১০০-১৫০টি ফল ধরে। তবে ভালো পরিচর্যা নিলে গাছপ্রতি ২০০-২৫০টি ফল পাওয়া যেতে পারে। একটি ডালিম গাছ ত্রিশ বছর পর্যন্ত লাভজনক ফলন দিয়ে থাকে।

Leave a Reply

Back to top button