রোগ ও প্রতিকার

ম্যালেরিয়া : কারণ ও প্রতিকার

ম্যালেরিয়া অনেক পুরনো রোগ হ’লেও একে মামুলি রোগ বলার কোন কারণ নেই। বিশ্বের প্রায় ১০০টি ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতি বছর পৃথিবীতে ১০-২০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যায়, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শহর ও শহরতলি এলাকায় ক্রমেই ম্যালেরিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের চলমানতা বেড়েছে অনেক। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল, এক দেশ থেকে আরেক দেশ এমনকি এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে মানুষের ঘন ঘন চলাচল আর আদান-প্রদান ম্যালেরিয়াকে পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করেছে। যেখানে ম্যালেরিয়া হয়ে পড়ছিল অস্তিত্বহীন, সেখানে আজ বেশ কিছু অঞ্চলে সে হয়ে পড়েছে মহামারী রোগ। নানা সীমাবদ্ধতা ও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার কারণে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ আশানুরূপ গতি পায়নি।

ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি যেসব ক্ষেত্রে বেড়ে যায় : সব বয়সেই ম্যালেরিয়া হ’তে পারে, তবে শিশু আর বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে অনেক সময় তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। শিশুর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় ভোগার সম্ভাবনা কম। কেননা এ সময় মায়ের শরীর থেকে পাওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তার শরীরে বিরাজ করে। তারপর থেকে তাদের সঙ্গে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। আবার পাঁচ বছর বয়স থেকে প্রতিরোধ ক্ষমতা আবার বাড়তে থাকে।

লিঙ্গ : পুরুষদের বেশী হারে ম্যালেরিয়ায় ভুগতে দেখা যায়। কেননা তারা অনেক বেশী সময় বাইরে কাজকর্ম করে। আমাদের দেশের মেয়েদের ম্যালেরিয়া হওয়ার হার কম। কেননা তারা বেশীরভাগ সময় শরীর ঢাকা দেওয়া কাপড়-চোপড় পরে।

গর্ভাবস্থা : গর্ভাবস্থায় ম্যালেরিয়ার সম্ভাবনা বেশী। এ সময় ম্যালেরিয়া হ’লে ভ্রূণের মৃত্যু বা আকস্মিক গর্ভপাতও হ’তে পারে। অজ্ঞানতা, অপুষ্টি, অসচেতনতার কারণে উন্নয়নশীল দেশের মানুষের ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি : উন্নত দেশগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ নেই বললেই চলে।

বাসস্থান : কম আলো-বাতাসযুক্ত বাড়ীতে বসবাসকারীদের মাঝে ম্যালেরিয়া অধিক হারে দেখা দেয়।

পেশা : ম্যালেরিয়া আগে শুধু গ্রামাঞ্চলের মানুষ, যারা চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত তাদেরই বেশী হ’ত। এখন ক্রমেই শহর ও শহরতলিতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। অপরিকল্পিত আবাসন, পয়ঃনিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি এ অসুখটাকে নিয়ে এসেছে শহরের দিকে।

জীবনাচরণ : খোলা জায়গায় ঘুমানো, মশারি ব্যবহার না করা, ঘরদোর পরিষ্কার না রাখা ইত্যাদি ম্যালেরিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অব্যবহৃত পাত্র, টায়ার, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে পানি জমা পড়ে তা মশার প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ঢাকাসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ শহরের ড্রেনের আবদ্ধ প্রায় জল মশার বিশাল প্রজনন ক্ষেত্র।

আবহাওয়া : আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া বেশী হয় জুলাই থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে, যখন তাপমাত্রা থাকে ২০-৩০ ফারেনহাইট আর বাতাসের আর্দ্রতা থাকে বেশী।

বৃষ্টিপাত : বৃষ্টি মশার বংশবৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তবে অতিবৃষ্টি মশার বংশবৃদ্ধি ব্যাহত করে।

ম্যালেরিয়ার লক্ষণ : ম্যালেরিয়ার সাধারণ লক্ষণ হ’ল শীত লাগা এবং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা। এটা বড়দের মধ্যেই অধিকহারে দেখা যায়। বাচ্চাদের অনেক সময় জ্বরের সঙ্গে পেটের গোলমাল, শ্বাসজনিত অসুবিধা ইত্যাদি দেখা যায়। ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চাদের মধ্যে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা ভাবটি লক্ষ্য করা যায় না। এর পরিবর্তে খিটখিটে ভাব, ঝিমুনি, খাওয়ার অনীহা, বমি, মাথাব্যথা, খুব বেশী জ্বর প্রভৃতি দেখা দিয়ে থাকে। পাঁচ বছরের বেশী বয়সীরা ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হ’লে প্রথমে শীত ও কাঁপুনি অনুভব করে, তারপর জ্বর ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে ১০৫ ফা. পর্যন্ত উঠতে পারে। সেই সঙ্গে প্রচন্ড মাথাব্যথা ও তারপর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে রোগী খুব দুর্বল বোধ করে। ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া ভয়াবহ আর জটিল আকার ধারণ করতে পারে শুরু থেকেই। খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, রক্তস্বল্পতা, প্রস্রাব কমে যাওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, কোমায় আচ্ছন্ন হওয়া ইত্যাদি জটিলতার লক্ষণ।

প্রাথমিক বিপদ সংকেত : ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। পানি অথবা খাবারের প্রতি খুব বেশী অনীহা, ঘন ঘন বমি হওয়া, খিঁচুনি ও ঝিমুনিভাব দেখা দিলে বা অজ্ঞান হয়ে পড়লে এবং রোগীর মাঝে অত্যধিক ক্লান্তি দেখা দিলে।

রোগ নির্ণয় : রক্তের মধ্যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু খুঁজে বের করা রোগ নির্ণয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। ম্যালেরিয়া সন্দেহ করলে যে কোন সময়ই রোগীর রক্ত পরীক্ষা করা যাবে। তবে তা অবশ্যই ওষুধ শুরু করার আগে। যদি প্রথম পরীক্ষায় কিছু না পাওয়া যায়, তবে পরপর তিনদিন পরীক্ষা করা উচিত। মাইক্রোস্কোপ ছাড়াও এখন ম্যালেরিয়ার এন্টিজেন পরীক্ষা করা হয়। এ ধরনের পরীক্ষায় কম সময় লাগে।

চিকিৎসা : চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য রোগ দ্রুত শনাক্তকরণ ও আরোগ্য লাভ। চিকিৎসা নির্ভর করে রোগী কী ধরনের ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে, ভাইভ্যাক্স না ফ্যালসিপেরামে। ম্যালেরিয়ার জন্য ক্লোরোকুইন সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ; কিন্তু পুরো কোর্স খেতে হবে। তবে এখন আরও ভাল ভাল ওষুধ দেশে আছে। ম্যালেরিয়ার জটিলতা দেখা দিলে সত্বর চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সব রকম সুব্যবস্থা আছে এমন হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা করা উচিত।

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ : ম্যালেরিয়াবাহী মশা সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে কামড়ায়। এ সময়টা দু’ভাগে ভাগ করা যায়। সন্ধ্যা থেকে শোয়ার আগে আর শোয়ার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বিছানায় যাওয়ার আগে শরীরের খোলা অংশগুলোতে মশা তাড়ানোর ক্রিম লাগাতে পারেন; কিন্তু এ ক্রিমগুলোর কার্যকারিতা স্বল্পস্থায়ী। মশারি ব্যবহার না করলে মশা তাড়ানোর ধুপ ও ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়িঘর ও আশপাশে যাতে মশা বংশবৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ছাদের ট্যাংকে ঢাকনা দিতে হবে, খালি টব, কৌটা উলটে রাখতে হবে। কোথাও অবাঞ্ছিত পানি জমতে দেওয়া যাবে না। ওষুধ খেয়ে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পদ্ধতিটি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা বিশেষ করে জঙ্গলে বেড়াতে গেলে বা সন্ধ্যাবেলায় খোলা জায়গায় যাবে না। বসলেও লম্বা হাতাওয়ালা জামা পরে বা ক্রিম লাগিয়ে বসতে হবে। রাতে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। ওষুধ খাওয়া শুরু করার পর ম্যালেরিয়া নির্ণয় করা বেশ কঠিন। চিকিৎসা করার আগে রক্ত পরীক্ষা করা একান্ত যরূরী। জ্বর হ’লেই ম্যালেরিয়া ধরে নিয়ে ওষুধ খাওয়ানো উচিত নয়।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Back to top button