রোগ ও প্রতিকার

ডেঙ্গু রোগীর জন্য করণীয় ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের কল্যাণেই আল্লাহ পৃথিবীতে যাবতীয় নে‘মত সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষের উপর আপতিত বিপদ-আপদ মানুষেরই দু’হাতের কামাই। আল্লাহ তা‘আলা যেমন দুরারোগ্য রোগ দিয়েছেন, তদ্রূপ তার প্রতিষেধক হিসাবে বিষাক্ত উদ্ভিদ, সাপ, মাকড়সা, কীটপতঙ্গ ইত্যাদিও সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তার ধৈর্য শক্তি, চিন্তা ও গবেষণা দ্বারা নে‘মতগুলো খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমানে দেশ-বিদেশে ডেঙ্গু রোগ মহামারী আকার ধারণ করায় যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রতিকারের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি ও করণীয় সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল।-

ডেঙ্গু কি : ডেঙ্গু হচ্ছে একটা ভাইরাসের নাম। এডিস ইজিপটি নামক স্ত্রী মশা দ্বারা মানব শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায়। এই মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু বহন করে। এরা সাধারণত স্বচ্ছ বদ্ধ পানিতে ডিম পেড়ে বংশ বিস্তার করে। এটি ভাইরাস জনিত রোগ হ’লেও কোন ছোয়াচে রোগ নয়। তবে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে কামড়ানো মশা সুস্থ শরীরে কামড় দিলে এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়।

ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ : ডেঙ্গু বিষয়ে মানুষের মাঝে জানা-শোনা থাকলেও এর গতি প্রকৃতি ও ধরন নিয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি, অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর বিশদ ধারণা নেই। ডেঙ্গু ভাইরাসের মোট চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। যথা- (ক) ডেন-১ (খ) ডেন-২ (গ) ডেন-৩ ও (ঘ) ডেন-৪। সাধারণত কেউ যদি একবার ডেন-১ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে পরবর্তীতে তার অন্য সেরোটাইপ ভাইরাস দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবার পর সাধারণ ডেঙ্গু নির্ণয়ের পাশাপাশি টাইপিং বের করাটাও যরূরী। নচেৎ সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়বে।

প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিস : প্রাথমিক অবস্থায় নিম্নোক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ সনাক্ত করা যায়। যথা- (ক) সিবিসি (খ) সিরাম আইজিজি (গ) সিরাম আইজিএম (ঘ) ডেঙ্গু এনএস ওয়ান এন্টিজেন।

ডেঙ্গু ভাইরাসের রোগাক্রান্তের স্তর : ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। যথা- ১. ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যাল, ২. ডেঙ্গু হেমোরেজিক, ৩. ডেঙ্গু শক-সিনড্রোম।

১. ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যাল : ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যালে প্রথমে প্রচন্ড জ্বর হয়, যা ১০৪-১০৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। জ্বর দুই হ’তে সাতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হ’তে পারে। জ্বরের সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা,  বমি বমি ভাব, চোখের পেছনের অংশে ব্যথা, পেশীতে ব্যথা, হাঁড়ের জয়েন্টগুলোতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব এবং সাথে শরীরে হাল্কা র‌্যাশ ও চুলকানী হতে পারে।

করণীয় : ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যাল খুব বেশী মারাত্মক নয়। এতে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব কম। জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে এবং বেশী করে তরল খাদ্য খেতে দিতে হবে। শরবত, ওরাল স্যালাইন, ফ্রেস ফ্রুট জুস ও পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাস জনিত রোগ, তাই এলোপ্যাথিক এন্টিবায়োটিক ঔষধের কোন কার্যকরী ভূমিকা নেই। আর ডেঙ্গু ভাইরাসের এন্টিভাইরাস এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।

চিকিৎসা : অতিরিক্ত জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে (যদি ডেঙ্গু পরীক্ষায় রিপোর্ট পজিটিভ হয়) তাহ’লে রোগের লক্ষণ অনুযায়ী একোনাইট ন্যাপ, এ্যানথ্রাক্সিনাম, আর্সেনিক এলবাম, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া এলবাম, আর্নিকা মন্ট, জেলসিমিয়াম, ওসিমামক্যান, ইউপেটোরিয়াম পার্ফ ইত্যাদি ঔষধ দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ঔষধের শক্তি ও মাত্রা রোগীর জীবনীশক্তির ওপর নির্ভর করে সূক্ষ্ম মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে।

২. ডেঙ্গু হেমোরেজিক : ডেঙ্গু হেমোরেজিক স্তরে জ্বর কমে যাওয়ার দুই-তিন দিন পরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল লাল র‌্যাশ বা রক্তের বিন্দুর ছাপ দেখা দেয়। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে মুখের মাড়ি, নাক দিয়ে আপনা আপনি রক্তক্ষরণ হয়, কাশি বা বমির সাথে রক্ত আসে, ইনটেস্টাইনাল হেমোরেজের কারণে কালো রঙের পায়খানা হয়, মুখমন্ডল ফুলে যায়, ফুসফুসের মধ্যে পানি জমে,  পেটে পানি জমে ইত্যাদি। রক্ত পরীক্ষা করলে দেখা যায়, প­াটিলেট কাউন্ট অনেক কমে এসেছে। শরীরের বিভিন্ন দ্বার দিয়ে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়।

করণীয় : ডেঙ্গু হেমোরেজিক স্তরে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে রক্ত শূন্যতা এবং প­াটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ার ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশী থাকে। এমতাবস্থায় রোগীকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে রোগীকে রক্ত দিতে হবে এবং নরমাল স্যালাইন (ডিএ ০.৫%) বা প­াজমা শিরাপথে পুশ করাতে হবে। এ সময়ে রোগী মুখে কোন তরল খাদ্য দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন নেই। পরবর্তীতে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হ’লে ফ্রেস ফ্রুট জুস, তরল খাদ্য স্যুপ ও বিশুদ্ধ পানি দেয়া যাবে।

চিকিৎসা : ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে বা ক্লিনিকে কোন অভিজ্ঞ রেজিষ্ট্রার্ড চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রেখে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম (হোল এবডোমেন), সিরাম ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা করে প্রয়োজন হ’লে রক্ত বা প­াটিলেট দিতে হবে। আর রোগের লক্ষণ অনুযায়ী এসিড নাইট্রিক, এপিস মেল, চিনিমাম আর্স, চায়না, ক্রোটেলাস হর, হ্যামামেলিস, ল্যাকেসিস ঔষধ দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ঔষধের শক্তি ও মাত্রা রোগীর জীবনী শক্তির উপর নির্ভর করে সূক্ষ্ম মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে।

৩. ডেঙ্গু শক সিনড্রোম : ডেঙ্গু শক-সিনড্রোম স্তরে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর, রক্তক্ষরণ ও অন্যান্য উপসর্গের সাথে রোগীর হঠাৎ রক্তচাপ কমে যায়, নাড়ীর গতি বৃদ্ধি পায়, হাত-পা শীতল হয়ে আসে, রোগী একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মুখমন্ডল বিবর্ণ ও ফ্যাকাসে হয়ে যায়। এমতাবস্থায় রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রক্তস্বল্পতা এবং দ্রুত প­াটিলেট কমে যাবার কারণে মস্তিষ্কে অক্সিজেন-এর ঘাটতি হওয়ায় অজ্ঞান হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

করণীয় ও চিকিৎসা : এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ  হাসপাতালে নিয়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, রক্ত বা প­াটিলেট, স্যালাইন (ডিএ ০.৫% বা ০.১০%) বা প­াজমা শিরাপথে দিতে হবে। আর রোগ লক্ষণ অনুযায়ী আর্নিকা মন্ট, এসিড নাইট, ক্যাস্ফর, কার্বোভেজ, চায়না, জেলসিমিয়াম, ডিজিটেলিস ঔষধ দেয়া যেতে পারে। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ঔষধের শক্তি ও মাত্রা  রোগীর জীবনী শক্তির উপর নির্ভর করে সূক্ষ্ম মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে।

ডেঙ্গুর প্রকোপজণিত জটিলতা : ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা রোগীর শরীরের বিভিন্ন ভাইটাল অঙ্গ যেমন- হৃৎপিন্ড, যকৃত, কিডনী ইত্যাদি আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হ’ল মায়োকার্ডিটিস বা হৃদযন্ত্রের প্রদাহ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী যদি সময়মত যথাযথ চিকিৎসা না নেয়, তাহ’লে এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশী। বিশেষত যাদের হৃৎপিন্ডের বিভিন্ন সমস্যা আছে তাদের (শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, বুকে ব্যথা, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা) ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্রই রক্ত পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, কার্ডিয়াক এনজাইম টেষ্ট, ট্রাপোনিন ওয়ান ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হ’তে হবে যে, মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হয়েছে কি-না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় : ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করতে হ’লে সর্বপ্রথম মশার কামড়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ‘এডিস মশা’ সাধারণত স্বচ্ছ অল্প পানিতে যেমন- বাসার ভেতরে জমে থাকা পানি, টবের পানি, ফ্রিজের পেছনে জমে থাকা পানি ইত্যাদিতে ডিম পাড়ে। তাই ফুলের টব সহ বাসার ভেতরে বা বাইরে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি দুই-চার দিন পরপর পরিস্কার করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যাতে বেশী কামড়ায়। অন্যান্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় মশারী টানাতে হবে। প্রয়োজনে মশার কয়েল, এরোসল স্প্রে ব্যবহার করতে হবে। শিশুদের মশা কামড়ানোর সময় ওরা মশা মারতে পারে না তাই সব সময় ফুলহাতা শার্ট, পায়জামা, হাত পায়ে মোযা পরিধান করাতে হবে।

ডেঙ্গু আতঙ্কগ্রস্ত দেশবাসীকে আশ্বস্থ করা যায় যে, ডেঙ্গুতে বেশী আতঙ্কিত না হয়ে রেজিষ্ট্রার্ড অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ধৈর্য সহকারে হোমিও ঔষধ সেবন করলে বা নিয়মিত সেবা নিলে সুস্থ থাকবেন ইনশাআল্লাহ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Back to top button